বুধবার ১২ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

>>

আমাদের বাংলা ভাষা

টিইও নূরুদ্দীন দরজী   |   মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫   |   প্রিন্ট

আমাদের বাংলা ভাষা

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে এ দেশের মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে ও বহু রক্ত ঢালতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য ঢাকার রাজপথে শহীদ হয়েছেন রফিক, জব্বার, সালাম সফিকসহ আরও অনেকে। কোনো জাতিকে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য অকাতরে রক্ত দিতে হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটি বিরল। আবার ভাষা নিয়ে সংগ্রাম করে ও ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মতো কোনো দেশ স্বাধীন হয়েছে এমনটি ও দেখা যায় না। অবশ্য কয়েকটি দেশের অঞ্চলভিত্তিক ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং নিজেদের ভাষায় কথা বলার জন্য আন্দোলন হয়েছে। অনেক অঞ্চল আন্দোলনে সফলও হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কানাডা, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কথা বলা যায়। কানাডার ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষী ক্যুবেক প্রদেশে ফ্রেঞ্চ ভাষার জন্য ক্যুবেকবাসী আন্দোলন করে সফল হয়েছেন। কানাডায় ইংরেজির পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়েছে এ ভাষা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শ্রীলঙ্কায় সিংহলি ও তামিল ভাষার মর্যাদা নিয়ে অনেক বড় বিরোধ হয়েছে। অবশেষে সেখানে দুটি ভাষাই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে। অন্যদিকে ভারতের আসাম প্রদেশের শিলচরে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে বসবাসকারীরা বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ১১ জনকে জীবন দিতে হয়েছে। ওই সময় আসাম সরকার অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। এর বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ কঠোর প্রতিবাদ করে। এতে কুমারী সুলক্ষনা বড়ুয়া ও সুলিল সরকারসহ ১১ জন প্রাণ দিয়ে তাদের এলাকায় বাংলা ভাষা চালু রেখেছে। ঘটনাটি ঘটে ১৯৬১ সালের ১৯ মে, যা এখন তারা ভাষাশহীদ দিবসরূপে পালন করে। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ‘৭১-এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি আমরা একসাগর রক্তের বিনিময়ে। বাংলা ভাষা আমাদের আবেগের সঙ্গে জড়িত। বহু আগ থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। পৃথিবীতে যে চারজন সাহিত্যিক সাধারণভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়ে আসছেন তাঁদের একজন বাংলা ভাষার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যরা ইংরেজিতে শেকসপিয়ার, রুশ ভাষায় লিও টলস্টয় এবং জার্মান ভাষায় মহাকবি গ্যোটে।

বাংলা অনেক পুরোনো ভাষা। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এ ভাষা সগৌরবে মহিমান্বিত ভাষা। পৃথিবীর পুরোনো কয়েকটি আলোচিত ভাষা যেমন, ফারসি, আরবি, ইংরেজি ও হিন্দির পর বাংলা ভাষার কথাবিবেচ্য। যদিও তামিল, সংস্কৃত, গ্রিক, হিব্রু ও চীনা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ভাষা ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু এগুলো বিবর্তিত হয়ে আগের অবস্থায় নেই। রুমী, হাফিজ ও ফেরদৌসির ফারসি অনেক পুরোনো ভাষা। আরবি ভাষাকেও বহু আগের মনে করা হয়। শেকসপিয়ার ও ইংরেজি ভাষার জনক চসারের ইংরেজি ভাষার বয়সও খুব বেশি নয় ১৫০০ বছর। হিন্দি ভাষার উদ্ভব ঘটেছে হাজার বছরের কিছু আগে থেকে। ১৯৪৭ সালে হিন্দি রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। অন্যদিকে উর্দু ভাষার বিকাশ আরম্ভ হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। ইকবাল, মির্জা গালিব ও তকী মীরের উর্দু ও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় ১৯৪৭ সালে। তুলনামূলক বিশ্লেষণে বাংলা ভাষা অন্য অনেক ভাষার আগে থেকে প্রচলিত। বাংলা ভাষার অন্য একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হলো এ ভাষার সম্মানার্থে, এ ভাষাভাষী মানুষের আত্মদান করতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল সন্তানেরা বুকের তাজা রক্ত দেয় বাংলার জন্য। এ দিনকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এদিন পৃথিবীব্যাপী মাতৃভাষা দিবস পালন করতে গিয়ে বিশ্ববাসী বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে। পাল আমলে প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিকশিত হতে থাকে। ওই সময়ের চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন। সেন আমলে সংস্কৃত ভাষা বেশি ব্যবহৃত হলেও বাংলা ভাষা ও চালু ছিল। পাঠান আমলে মুসলিম শাসনের সময় ফারসি রাজকীয় ভাষা হিসেবে গণনা করা হতো। কিন্তু বাংলা অবহেলিত ছিল না। কবি চন্ডীদাস ও বিজয় গুপ্তের মতো কবিরা বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি করেছেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে নবতর ধারা সূচিত হয়। সুলতান বাংলাকে আলাদাভাবে প্রাধান্য দেন। ওই সময় সুফি দরবেশগণ বাংলায় কথা বলতে চেষ্টা করেছেন। ওই সময়েই বাংলা ভাষায় মঙ্গলকাব্যসহ অন্যান্য কাব্য রচিত হয়েছিল। অনুরূপভাবে মুঘল আমলে ফারসিকে সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার করলেও বাংলা ভাষার কদর ছিল। ঢাকায় মুঘল সুবাদারদের পৃষ্ঠপোষকতা পায় বাংলা। ইংরেজ শাসন-শোষণ আমলে বাংলা ভাষার প্রচুর ব্যবহার হয়। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রাচীন এবং আধুনিককালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও হুমায়ূন আহমেদ বাংলা ভাষাকে সবার জন্য করে গেছেন। আরও অনেক মনীষী বাংলা ও বাংলা ভাষার জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।

■ লেখক: প্রাবন্ধিক

Facebook Comments Box

Posted ১২:৪৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

dainikbanglarnabokantha.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

রূপা
(1578 বার পঠিত)
ছোটগল্প (দেনা)
(1090 বার পঠিত)
দূর দেশ
(947 বার পঠিত)
কচু শাক চুরি
(895 বার পঠিত)
কৃষ্ণ কলি
(876 বার পঠিত)

সম্পাদক

রুমাজ্জল হোসেন রুবেল

বাণিজ্যিক কার্যালয় :

১৪, পুরানা পল্টন, দারুস সালাম আর্কেড, ১১ম তলা, রুম নং-১১-এ, ঢাকা-১০০০।

ফোন: ০১৭১২৮৪৫১৭৬, ০১৬১২-৮৪৫১৮৬, ০২ ৪১০৫০৫৯৮

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

design and development by : webnewsdesign.com

nilüfer escort coin master free spins